উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

১৮৬৩-১৯১৫ মূলত বাংলা শিশুসাহিত্যে নবযুগের প্রবর্তকরূপে পরিচিত হলেও এই বহুমাত্রিক মানুষটির পরিচয় এক কথায় দেওয়া যায় না। গল্পকার, কবি, প্রবন্ধকার, গ্রন্থচিত্রী, সম্পাদক, মুদ্রক, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, আলোকচিত্রী, বৈজ্ঞানিক, কারিগরিবিদ ও ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে তিনি তাঁর পরিচিতি রেখে গেছেন স্পষ্টভাবেই। দেশজুড়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সার্ধশতবর্ষ উদ্যাপনের পটভূমিতেও তাঁর সম্পূর্ণ পরিচয় পাঠকসমাজ পেয়েছেন কি না জানা নেই। তিনি নিজেকে ময়মনসিংহী বাঙালবলে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন, অবশ্য সেকালের ময়মনসিংহ জেলা ছিল আয়তন ও জনসংখ্যায় অবিভক্ত বঙ্গে বৃহত্তম। বাড়িতেও তাঁরা ময়মনসিংহের প্রচলিত কথ্যভাষা ব্যবহার করতেন। শোনা যায়, তাঁর দাদা অধ্যক্ষ সারদারঞ্জন রায়কে উদ্দেশ করে ছড়া কেটে বলেছিলেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার : কিছুতেই হয় না রাজি, ময়মনসিংহের বাঙাল পাজি!অবশ্য বর্তমানে সাবেক ময়মনসিংহ জেলা ছয়টি জেলায় বিভক্ত। উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার (তখন মহকুমা) মসুয়া গ্রামে, যা এখন কাটিয়াদি বা কট্যাদি (কটিয়াদি) উপজেলার (এবং থানা) অন্তর্ভুক্ত একটি ইউনিয়ন (ভারতে গ্রাম পঞ্চায়েত)।

একথা অনেকেরই জানা নেই যে, জন্মসূত্রে তাঁর নাম উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নয়, কামদারঞ্জন রায় - পিতা কালীনাথ রায়ের জ্ঞাতিভাই জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাঁকে দত্তক নিলে নাম পরিবর্তিত হয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী হয়, যদিও পরিণত বয়সে তিনি উপেন্দ্রকিশোর রায় লিখতেন। এই বংশের আদি কৌলিক পদবি কিন্তু রায় বা রায়চৌধুরী নয়, দেব। নবাবি সেরেস্তায় কাজ করে এ-বংশের অনেকেই মজুমদার, খাসনবিস, রায় বা রায়চৌধুরী উপাধি লাভ করেন। এঁদের আদি বাসস্থানও এই মসুয়া গ্রামে নয়। ষোড়শ শতকের শেষদিকে এই বংশের আদিপুরুষ রামসুন্দর দেব ভাগ্যান্বেষণে নদিয়া জেলার চাকদহ ছেড়ে সুদূর উত্তরে ময়মনসিংহের শেরপুর পরগনায় পাড়ি দেন (এখন শেরপুর একটি স্বতন্ত্র জেলা) - তখন ময়মনসিংহ নামটির পরিচিতি ছিল না, কিন্তু ঈসা খাঁর রাজত্বে শেরপুর ছিল বেশ জমজমাট। এখানে এসে শেরপুরের জমিদারির কাছারিতে তিনি কাজ নেন এবং কালক্রমে যশোদলের জমিদার গুণীরাম (গুণিকচন্দ্র) রায়ের মেয়েকে বিবাহ করে যশোদল গ্রামে বাস আরম্ভ করেন। রামসুন্দরের পর তাঁর পুত্র লম্বোদর, পৌত্র মুকুন্দরাম বোদেশপ্রাণ, প্রপৌত্র শ্রীরাম, প্রপ্রপৌত্র নারায়ণ এবং তাঁর দুই পুত্র জয়ানন্দ ও রামানন্দ এই যশোদল গ্রামেই বাস করেছেন। কিন্তু জয়ানন্দের তৃতীয় পুত্র রামনারায়ণ প্রথম মসুয়া গ্রামে পা রাখেন।

শোনা যায়, আগে গ্রামটির নাম ছিল খুকুরপাড়া, রামনারায়ণকে খাতির করে আশপাশের গ্রামের মানুষ মউস্যাবলে ডাকত বলেই গ্রামের নাম হয় মসুয়া। জঙ্গলবাড়ির জমিদারদের কাছারিতে কাজ করে রামনারায়ণ কিছু জমিজমা পত্তনি নেন ও রায় উপাধি লাভ করেন। শুধু রামনারায়ণই নন, তাঁর পুত্র কৃষ্ণজীবন, পৌত্র ব্রজরাম ও প্রপৌত্র রামকান্ত (রায় বা মজুমদার) জঙ্গলবাড়ি কাছারিতে কাজ করতেন, তাঁদের বাসাবাড়ি ছিল এগারসিন্দুর গ্রামে, কিন্তু স্থায়ী বাসস্থান ছিল মসুয়া গ্রামে, আদি ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। তখন এটি মূল ব্রহ্মপুত্রের জলধারা বহন করত, এখন প্রায় একটি নালায়  রূপান্তরিত। ১৭৭৬ সালের রেনেলের মানচিত্রে তা দেখা যায় - প্রসঙ্গত বলা যায়, এই মানচিত্রে জঙ্গলবাড়ি, এগারসিন্দুর, কাটিয়াদি, বাজিতপুর প্রভৃতি নিকটস্থ স্থানের হদিস পাওয়া গেলেও উল্লেখ নেই  মসুয়ার। অবশ্য ময়মনসিংহ বা কিশোরগঞ্জ টাউনেরও উল্লেখ নেই - ময়মনসিংহ জেলা সৃষ্ট হয় ১৭৮৭ সালে, সম্ভবত ১৭৯১ নাগাদ বন্যায় বেগুনবাড়ি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেলে ময়মনসিংহ জেলা সদর হয়। রামনারায়ণের নাতি ব্রজরামের সময়ে ব্রহ্মপুত্রের বন্যায় মসুয়া গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেলে তাঁরা নতুন করে বাস আরম্ভ করেন বড় মসুয়াবা কায়স্থপাড়া গ্রামে - এটিই আজকের মসুয়া।

ব্রজরাম ও তাঁর ভাই বিষ্ণুরাম এই গ্রামে পাশাপাশি দুটি বাড়ি তৈরি করে বাস করতে আরম্ভ করেন। কালক্রমে ব্রজরামের বংশধররা সচ্ছল হলেও সাধক, কবি ও সংগীতপ্রেমী বলে পরিচিত হলেন আর বিষ্ণুরামের বংশধররা প্রচুর বিষয়সম্পত্তি করেন। ব্রজরামের পুত্র রামকান্ত দৈহিক শক্তি ও গানবাজনার জন্য পরিচিত ছিলেন আর তাঁর পৌত্র লোকনাথ জরিপের কাজে দক্ষ হয়েও তন্ত্রসাধক হয়ে দাঁড়ান। সে-সাধনায় তাঁর পিতা বাধা দিলে তিনি অল্পবয়সে প্রাণত্যাগ করেন - কিংবদন্তি অনুসারে প্রায় ইচ্ছামৃত্যু’! এই লোকনাথের একমাত্র পুত্র কালীনাথ রায়ই উপেন্দ্রকিশোরের পিতা। অন্যদিকে বিষ্ণুরামের বংশধররা প্রচুর বিষয়সম্পত্তির অধিকারী হয়ে দাঁড়ান। বিষ্ণুরামের পুত্র সোনারাম ও পৌত্র গঙ্গাধর সম্পত্তি বৃদ্ধি করলেও তাঁর প্রপৌত্র হরিকিশোর ছিলেন উকিল, তিনি এই ভূসম্পত্তি প্রচুর বাড়িয়ে জমিদারি ক্রয় করেন এবং রায়চৌধুরী উপাধি লাভ করেন।

বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েও হরিকিশোর ছিলেন অসুখী। কারণ তিনবার বিবাহ করলেও তাঁর পুত্রসন্তান ছিল না। অন্যদিকে কালীনাথ (যিনি শ্যামসুন্দর মুন্সী নামে পরিচিত ছিলেন) ইতোমধ্যেই লাভ করেছিলেন তিন পুত্র - শেষাবধি তার পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে হয়। হরিকিশোরের অনুরোধে কালীনাথ তাঁর দ্বিতীয় পুত্রকে হরিকিশোরকে দত্তক দিতে রাজি হন - তাঁর নাম পরিবর্তিত হয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী হয়। সম্ভবত এটি ১৮৬৮ সালের কথা। এর দুবছর বাদেই হরিকিশোরের নিজের পুত্র নরেন্দ্রকিশোরের জন্ম হয়। অবশ্য তাতে উপেন্দ্রকিশোরের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি - দুই ভাইয়ের সৌহার্দ্য অটুট ছিল। উপেন্দ্রকিশোর বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হলেও ছেলেবেলা থেকেই তাঁর হৃদয়জুড়ে ছিল চিত্রকলা, সংগীত আর সাহিত্যচর্চা। পাশাপাশি বাড়িতে বাস করতেন বলে তাঁর সহোদর ভাইবোনের সঙ্গেও গভীর সৌহার্দ্যের সম্পর্ক ছিল আজীবন। তাঁর বড় দাদা সারদারঞ্জন ছিলেন গণিত ও সংস্কৃতের অধ্যাপক, কালে মেট্রোপলিটন  কলেজের অধ্যক্ষ ও বাংলার ক্রিকেটের জনকনামে সুপরিচিত; তৃতীয় ভাই মুক্তিদারঞ্জনও গণিত ও সংস্কৃতের অধ্যাপক এবং খেলাধুলায় দক্ষ; চতুর্থ ভাই কুলদারঞ্জন শিশুসাহিত্যিক ও অনুবাদক হিসেবে সুপরিচিত; এবং পঞ্চম ভাই প্রমদারঞ্জন (বর্তমান লেখকের পিতামহ) ছিলেন জরিপ বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। অনুমান করি, তাঁর ছেলেবেলাটা কেটেছে এই মসুয়া গ্রামে, অনেক আনন্দে বাঁশি বাজিয়ে ও ছবি এঁকে। তাঁদের পরিবারের প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়েই তাঁদের সব ভাইয়ের পড়াশোনা আরম্ভ - এখন অবশ্য তার পাশেই গড়ে উঠেছে মসুয়া হাইস্কুল।

সম্ভবত ১৮৭৪-৭৫ নাগাদ উপেন্দ্রকিশোর পড়তে আসেন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে। ময়মনসিংহ শহরে হরিকিশোরের এক বিশাল দোতলা বাড়ি ছিল। তার সামনে ছিল মস্ত ফুটবল মাঠ। জমিদারি তত্ত্বাবধানে এবং আদালতের কাজে হরিকিশোরকে প্রায়ই ময়মনসিংহ আসতে হতো। সামনের রাস্তাটির নামও ছিল হরিকিশোর রোড, আজো সে-নাম আছে কি না জানা নেই। এ-বাড়িতে থেকে উপেন্দ্রকিশোর পড়াশোনা করতেন, অবশ্য তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব আরো কয়েকটি ছেলে সেখানে থেকে পড়াশোনা করতেন। একটু বড় হলে নরেন্দ্রকিশোরকে নিয়ে তাঁর পালিকা মা রাজলক্ষ্মী দেবীও এখানে থাকতেন, হরিকিশোরও প্রয়োজন অনুসারে এখানে থাকতেন। অন্য সময়ে উপেন্দ্রকিশোরের তত্ত্বাবধানের ভার ছিল গুপিদা নামে এক বিশ্বাসী চাকরের ওপর। সুন্দর চেহারা, মিষ্টি স্বভাব ও পড়াশোনায় সাফল্যের জন্য তিনি সকলের প্রিয় ছিলেন। চিত্রবিদ্যা ও সংগীতে উপেন্দ্রকিশোরের আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। তিনি নিজেই বেহালা বাজাতে শেখেন ও শোনা যায়, নতুন কোনো গৎ শুনে তখনই গুপিদাকে দিয়ে বেহালা আনিয়ে সে গৎ তুলে ফেলেন। স্কুলে ছোটলাট স্যার অ্যাশলি ইডেন পরিদর্শনে এলে উপেন্দ্রকিশোর চটপট তাঁর ছবি এঁকে নেন। ব্যাপারটি লাটসাহেবের নজরে এলে মাস্টারমশাইরা ভয়ে কাঠ হয়ে যান, কিন্তু লাটসাহেব তারিফ করে তাঁর পিঠ চাপড়ে দেন আর বলেন, ছবি অাঁকা না ছাড়তে। তা তিনি ছাড়েনওনি। তখন জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন রতনমণি গুপ্ত আর হেডপন্ডিত শ্রীনাথ চন্দ। দুজনেই উপেন্দ্রকিশোরকে খুব ভালোবাসতেন। ফোর্থ ক্লাস থেকে এখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন গগনচন্দ্র হোম (১৮৫৭-১৯২৯)। বয়সে বেশ কিছুটা বড় হলেও দুজনের বন্ধুত্ব ছিল গভীর এবং আজীবন।

No comments

Theme images by luoman. Powered by Blogger.