একজন অসামান্য দেশপ্রেমিক ক্ষুদিরামের গল্প।
ফাঁসির মঞ্চে হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন তিনি ক্ষুদিরাম, নশ্বর দেহ ত্যাগ করে চিরন্তন প্রেরণার নাম হয়েছেন তিনি ক্ষুদিরাম ,অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকার নাম ক্ষুদিরাম, অদম্য সাহস আর নিখাদ দেশপ্রেমের কাছে প্রতাপশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কে অবজ্ঞা করে ব্রিটিশের গায়ে খানিকটা হলেও দাগ কেটে যাওয়া ব্যক্তির নাম ক্ষুদিরাম, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিপ্লব ঘটনার পথ তৈরি করে দেওয়া
ব্যক্তির নাম ক্ষুদিরাম।
১৮৮৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর অবিভক্ত বাংলার মেদিনীপুর জেলার হাবিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ক্ষুদিরাম । ত্রৈলক্যনাথ ও লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর ঘরে তিন মেয়ের পর জন্ম হয় ক্ষুদিরাম এর। ক্ষুদিরাম এর আগে লক্ষীপ্রিয়ার আর দুই ছেলের জন্ম হলেও তারা মারা যায় প্রসবকালে। কুসংস্কারে বিশ্বাসী লক্ষীপ্রিয়া সন্তানের মৃত্যু ঠেকাতে তিনমুঠো চালের খুদের একটি বিশেষ শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান পালন করেন,পরে শিশু ক্ষুদিরাম সুস্থভাবে জন্ম নিলে ধারণা করা হয় তিন মুঠো খুদ-ই তার জীবন রক্ষা করেছে, তাই তার নামকরণ করা হয় ক্ষুদিরাম। আসলে সিরিয়ালের কাহিনীকেও হার মানায় এই তিন মুঠো খুদের প্রথা।এই প্রথা অনুযায়ী সন্তান বাঁচাতে হলে শিশুটিকে কারো কাছে তিন মুঠো খুদের বিনিময় বিক্রি করে দিতে হতো। লক্ষ্মীপ্রিয়া তার সন্তানকে নিজের বড় মেয়ে অপরূপার কাছে বিক্রয় করেছিলেন এবং সন্তানের সাথে চিরতরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিলেন । ক্ষুদিরাম বেঁচে ছিলেন ঠিকই কিন্তু মা বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে, কেননা জন্ম থেকেই তিনি বড় হন নিজের দিদির কাছে।
ক্ষুদিরামের প্রতিটি রক্তের ফোঁটায় বিপ্লব মেশানো ছিল। শুরু থেকেই তিনি বিপ্লবী দের ন্যায় তেজদীপ্ত ছিলেন। পরিস্থিতি অনুযায়ী নেতৃত্ব দেবার সহজাত গুণাবলীও তার মাঝে দ্রুতও বিকশিত হয়। ১৯০৩ সালে স্যার অরবিন্দ এবং নিবেদিতা মেদিনীপুর গিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জনগণকে উৎসাহিত করতে। মাত্র 14 বছর বয়সী টগবগে কিশোর ক্ষুদিরাম সে দিনের সেই বক্তৃতা শুনে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এরপর তিনি অরবিন্দের গোপন পরিকল্পনায় অংশ নেন। ১৯০৪ সালে মেদিনীপুরের শহরে চলে আসেন, সেখানে তিনি মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু করেন। তার এই সক্রিয় রাজনীতির পিছনে কেবল মাত্র স্যার অরবিন্দের অনুপ্রেরণাই নয়, কাজ করেছিল তা নয় তার শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর 'জাগরণী মঞ্চ'। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দেন ক্ষুদিরাম।( দেশের জন্য পুরোদমে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় যে হয়ে গিয়েছিল)। তিনি যোগ দিলেন যুগান্তর নামক বিপ্লবী এক রাজনৈতিক সংগঠনে।
মুজাফ্ফরপুরের ঘটনা সেইসময় কলকাতার প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন কিংসফোর্ড। যুগান্তরের সাংগঠনিক প্রধানরা কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা করলেন। দায়িত্ব দেয়া হল দুই তরুণ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকীকে। দায়িত্ব নিয়ে নাম পালটে ক্ষুদিরাম হয়ে গেলেন হারেন সরকার আর প্রফুল্ল হলেন দীনেশ রয় । তারা তখন মুজাফ্ফরপুর গিয়ে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্মশালায় আশ্রয় নিলেন। তখন পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা কোর্টের আশপাশে অবস্থান নিলেন, কিংসফোর্ড বের হলেই বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত সাধারন মানুষের প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কায় তাঁরা এই পরিকল্পনা বাদ দিলেন ।কিংসফোর্ডকে গুলি করে মারার সিদ্ধান্ত নিলেন। ৩০শে এপ্রিল, ১৯০৮ সাল ক্ষুদিরাম বসু প্রফুল্ল চাকী অবস্থান নিয়েছেন ইউরোপিয়ান ক্লাবের বাইরে.... কিংসফোর্ডের গাড়ি সেখানে পৌঁছানো মাত্রই উভয়ে একত্রে গাড়ীতে বোমা ছুঁড়লেন ও গুলি চালালেন।গাড়ির ভিতর সবাই মারা গেছে অনুধাবন করে উভয়ে যেখান থেকে দ্রুত পালিয়ে যান । কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন কিংসফোর্ড মারা যান নি। তার গাড়ির ভেতরে ছিল কলকাতার একজন ব্যারিস্টারের স্ত্রী-কন্যা। এই খবর পেয়ে অনুতাপে মুষড়ে পড়েন দুই তরুণ যুবক। তাছাড়া তখন থেকেই তারা পুলিশের নজর এড়িয়ে চলা শুরু করতে আরম্ভ করেন।
প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যু কিংসফোর্ডকে মারার ব্যর্থ চেষ্টার পর ,ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকী ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা অবলম্বন করেছিলেন মেদিনীপুর ফিরে যাবার জন্য। প্রফুল্ল চাকী এসময় মোজাফফরপুর এর এক স্থানীয় বাসিন্দারা বাড়িতে আশ্রয় লাভ করেন... বাড়ির মালিক প্রফুল্ল চাকীকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে যত্ন করেছিলেন এবং কলকাতা যাওয়ার টিকিট কেটে দিয়েছিলেন। কোলকাতা যাবার
মাঝপথে ট্রেন পরিবর্তন করতে হতো প্রফুল্ল চাকীকে ।তবে হাওড়া যাবার সেই দ্বিতীয় টেনে আর ওঠা হয়নি তার ।প্রথম ট্রেনের ভিতরেই তাকে দেখে সন্দেহ করে ব্রিটিশ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জি, খুব দ্রুতই তথ্য মিলিয়ে তিনি প্রফুল্ল চাকীর মোজাফফরপুর ঘটনার সাথে যোগ থাকার কথা উদঘাটন করেন। ট্রেন পরিবর্তন করতে প্রথম ট্রেন থেকে নেমে পড়তেই প্রফুল্ল চাকীকে নন্দলাল ব্যানার্জি ও তার কনস্টেবলরা ঘিরে ফেলেন। প্রফুল্ল চাকী প্রথমের নন্দলাল কে গুলি করে মারতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, তারপর তিনি নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তবুও ব্রিটিশ পুলিশের হাতে নিজেকে ধরা দেননি।
অন্য দিকে ক্ষুদিরাম মোজাফ্ফরপুর থেকে বের হবার পথ করছিলেন ঘটনার পরপর ই পুরো মোজাফফরপুর জুড়ে সশস্ত্র পুলিশে ছেয়ে যায়। বিশেষ করে ট্রেন স্টেশন গুলোতে বসানো হয় পুলিশের কড়া পাহারা। তাই ক্ষুদিরাম ঠিক করলেন হেঁটেই মোজাফফরপুর থেকে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার জন্য অপেক্ষা করছিল ওয়াইনি নামক স্থানে। দীর্ঘ পথ হেঁটে সেখানে একটু জলের জন্য একটি চায়ের দোকানে দাঁড়ালেন ক্ষুদিরাম, আর তখন পাশে থাকা কনস্টেবলদের সন্দেহের নজর ক্ষুদিরামের উপর পরে। তারা ক্ষুদিরামের দেহ তল্লাশি চালিয়ে একটি রিভলভার এবং ৩৭ রাউন্ড গুলি পান, গ্রেফতার হলেন ক্ষুদিরাম। দিনটি ছিল ১৯০৮ সালের ১লা মে । কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা একজন ১৪ বছরের যুবক। তাঁকে গ্রেফতার করে তখন মুজাফ্ফরপুর স্টেশনে নিয়ে আসা হলো তখন , হাজারো মানুষ ভীড় করেছে সেখানে একজন সন্ত্রাসী কে দেখবে বলে। চারিদিকে মানুষের বিস্ময় ভরা দৃষ্টির মধ্যে ক্ষুদিরাম কেবল কাঁপা কাঁপা গলায় অভিরাম বলে গেলেন, ‘বন্দেমাতারাম’। তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে নিয়ে গিয়ে পুলিশ মারধরসহ সব রকমের চেষ্টা চালিয়ে ছিল, সেই ঘটনার সাথে আর কে বা কারা যুক্ত আছে তা জানার জন্য। কিন্তু ক্ষুদিরামের মুখ থেকে একটি শব্দ বের হয়নি তার সাথীদের ব্যাপারে। তিনি পুরো ঘটনার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন।
কিন্তু যখন তার সামনে মৃত প্রফুল্ল চাকীর দেহ আনা হলো তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং সব স্বীকার করলেন।
আদালতের বিচার এবং মৃত্যু ক্ষুদিরামকে ২রা মে কারাগারে পাঠানো হয়, ২১ মে তার বিচারকার্য শুরু হয়। উপেন্দ্রনাথ সেন, কালিদাস বসু আর স্বেত্রানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার পক্ষের আইনজীবী হলে লড়াই করেন। তারা কেউই এই কাজের জন্য কোন প্রকার অর্থ নেন নি। তাদের উপদেশ অনুযায়ী ক্ষুদিরাম 23শে মে তারিখে নিজের প্রথম জবানবন্দিতে মোজাফফরপুর ঘটনার সাথে নিজের সংযোগ অস্বীকার করেন। আদালতে চূড়ান্ত রায়ের দিন ধার্য হয় ১৩ই জুন। এদিকে ১২ই জুন ঘটনায় অন্য মোড় আসে, আদালতের বিচারকরা একটি বেনামি চিঠি পান যাতে লেখা ছিলো-" আরো অনেক বড় বোমা হামলার ঘটনা ঘটবে যা কোন বাঙালি নয় বরং কোনও বিহারী রা ঘটাবে।" এই চিঠির প্রেক্ষিতে ক্ষুদিরামের আইনজীবীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ক্ষুদিরামের ফাঁসির রায় ঠেকাতে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার, বিদ্রোহী ও বিপ্লবী ক্ষুদিরাম কে ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে যা হবার তাই হলো আর ১৩ই জুন চূড়ান্ত রায়ে ক্ষুদিরামের ফাঁসির রায়ে হলো, তিনি হাসিমুখে সে রায় মেনে নিলেন এমনকি উচ্চ আদালতে আপিল করবেন না বলে দাও জানিয়ে দিলেন। কিন্তু তার উকিলরা তাকে এই বলে রাজি করালেন যে আপিল করে যদি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যায় তাহলে ক্ষুদিরাম পরবর্তীতে দেশের জন্য আরো অনেক কাজ করতে পারবেন। রাজি হলেন ক্ষুদিরাম, আপিল হলো উচ্চ আদালতে। এবার খুদি রামের পক্ষে লড়লেন নরেন্দ্র কুমার বসু।৮ই জুলাই প্রথম শুনানিতে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর ১৩ই জুলাই রায় এর দিন ধার্য করা হয়। নরেন্দ্র কুমার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে এই রায়ে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করার দিকে নিয়ে যান ঠিকই কিন্তু কোন উপায় হল না মৃত্যুদণ্ড শেষ পর্যন্ত বহাল থাকে। শেষে গভর্নরের কাছে আপিল করা হয় কিন্তু 11 ই আগস্ট ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল আপিল প্রত্যাখ্যান করে দিলে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। এই রায় সর্বস্তরের জনগণের মনের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। হাজারো মানুষ জড়ো হয় আদালতের সামনে তারা স্লোগান দিতে থাকে ক্ষুদিরামের পক্ষে। সংবাদপত্রগুলো ক্ষুদিরামের পক্ষে প্রচার প্রচার চালায়। কিন্তু মৃত্যু ছিল অবধারিত আর সেদিনই ক্ষুদিরাম হাসতে হাসতে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে পরেন ।
মৃত্যু সে আবার কী? ক্ষুদিরাম কে কী বোকা ব্রিটিশ সত্যিই মারতে পেরেছিল? বরং তরুণ প্রজন্মের মনে ক্ষুদিরামের মৃত্যুর জন্য প্রতিশোধের আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। ক্ষুদিরাম আসলেতো আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, তার বৈপ্লবিক আদর্শ আমাদের রক্তে বইছে ।লোক কবি পিতাম্বর দাসের সেই কালজয়ী গান যা আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে যায়।।
ফাঁসির মঞ্চে হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন তিনি ক্ষুদিরাম, নশ্বর দেহ ত্যাগ করে চিরন্তন প্রেরণার নাম হয়েছেন তিনি ক্ষুদিরাম ,অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকার নাম ক্ষুদিরাম, অদম্য সাহস আর নিখাদ দেশপ্রেমের কাছে প্রতাপশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কে অবজ্ঞা করে ব্রিটিশের গায়ে খানিকটা হলেও দাগ কেটে যাওয়া ব্যক্তির নাম ক্ষুদিরাম, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিপ্লব ঘটনার পথ তৈরি করে দেওয়া
ব্যক্তির নাম ক্ষুদিরাম।
![]() |
khudiram Bose |
১৮৮৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর অবিভক্ত বাংলার মেদিনীপুর জেলার হাবিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ক্ষুদিরাম । ত্রৈলক্যনাথ ও লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর ঘরে তিন মেয়ের পর জন্ম হয় ক্ষুদিরাম এর। ক্ষুদিরাম এর আগে লক্ষীপ্রিয়ার আর দুই ছেলের জন্ম হলেও তারা মারা যায় প্রসবকালে। কুসংস্কারে বিশ্বাসী লক্ষীপ্রিয়া সন্তানের মৃত্যু ঠেকাতে তিনমুঠো চালের খুদের একটি বিশেষ শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান পালন করেন,পরে শিশু ক্ষুদিরাম সুস্থভাবে জন্ম নিলে ধারণা করা হয় তিন মুঠো খুদ-ই তার জীবন রক্ষা করেছে, তাই তার নামকরণ করা হয় ক্ষুদিরাম। আসলে সিরিয়ালের কাহিনীকেও হার মানায় এই তিন মুঠো খুদের প্রথা।এই প্রথা অনুযায়ী সন্তান বাঁচাতে হলে শিশুটিকে কারো কাছে তিন মুঠো খুদের বিনিময় বিক্রি করে দিতে হতো। লক্ষ্মীপ্রিয়া তার সন্তানকে নিজের বড় মেয়ে অপরূপার কাছে বিক্রয় করেছিলেন এবং সন্তানের সাথে চিরতরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিলেন । ক্ষুদিরাম বেঁচে ছিলেন ঠিকই কিন্তু মা বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে, কেননা জন্ম থেকেই তিনি বড় হন নিজের দিদির কাছে।
ক্ষুদিরামের প্রতিটি রক্তের ফোঁটায় বিপ্লব মেশানো ছিল। শুরু থেকেই তিনি বিপ্লবী দের ন্যায় তেজদীপ্ত ছিলেন। পরিস্থিতি অনুযায়ী নেতৃত্ব দেবার সহজাত গুণাবলীও তার মাঝে দ্রুতও বিকশিত হয়। ১৯০৩ সালে স্যার অরবিন্দ এবং নিবেদিতা মেদিনীপুর গিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জনগণকে উৎসাহিত করতে। মাত্র 14 বছর বয়সী টগবগে কিশোর ক্ষুদিরাম সে দিনের সেই বক্তৃতা শুনে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এরপর তিনি অরবিন্দের গোপন পরিকল্পনায় অংশ নেন। ১৯০৪ সালে মেদিনীপুরের শহরে চলে আসেন, সেখানে তিনি মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু করেন। তার এই সক্রিয় রাজনীতির পিছনে কেবল মাত্র স্যার অরবিন্দের অনুপ্রেরণাই নয়, কাজ করেছিল তা নয় তার শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর 'জাগরণী মঞ্চ'। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দেন ক্ষুদিরাম।( দেশের জন্য পুরোদমে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় যে হয়ে গিয়েছিল)। তিনি যোগ দিলেন যুগান্তর নামক বিপ্লবী এক রাজনৈতিক সংগঠনে।
মুজাফ্ফরপুরের ঘটনা সেইসময় কলকাতার প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন কিংসফোর্ড। যুগান্তরের সাংগঠনিক প্রধানরা কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা করলেন। দায়িত্ব দেয়া হল দুই তরুণ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকীকে। দায়িত্ব নিয়ে নাম পালটে ক্ষুদিরাম হয়ে গেলেন হারেন সরকার আর প্রফুল্ল হলেন দীনেশ রয় । তারা তখন মুজাফ্ফরপুর গিয়ে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্মশালায় আশ্রয় নিলেন। তখন পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা কোর্টের আশপাশে অবস্থান নিলেন, কিংসফোর্ড বের হলেই বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত সাধারন মানুষের প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কায় তাঁরা এই পরিকল্পনা বাদ দিলেন ।কিংসফোর্ডকে গুলি করে মারার সিদ্ধান্ত নিলেন। ৩০শে এপ্রিল, ১৯০৮ সাল ক্ষুদিরাম বসু প্রফুল্ল চাকী অবস্থান নিয়েছেন ইউরোপিয়ান ক্লাবের বাইরে.... কিংসফোর্ডের গাড়ি সেখানে পৌঁছানো মাত্রই উভয়ে একত্রে গাড়ীতে বোমা ছুঁড়লেন ও গুলি চালালেন।গাড়ির ভিতর সবাই মারা গেছে অনুধাবন করে উভয়ে যেখান থেকে দ্রুত পালিয়ে যান । কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন কিংসফোর্ড মারা যান নি। তার গাড়ির ভেতরে ছিল কলকাতার একজন ব্যারিস্টারের স্ত্রী-কন্যা। এই খবর পেয়ে অনুতাপে মুষড়ে পড়েন দুই তরুণ যুবক। তাছাড়া তখন থেকেই তারা পুলিশের নজর এড়িয়ে চলা শুরু করতে আরম্ভ করেন।
প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যু কিংসফোর্ডকে মারার ব্যর্থ চেষ্টার পর ,ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকী ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা অবলম্বন করেছিলেন মেদিনীপুর ফিরে যাবার জন্য। প্রফুল্ল চাকী এসময় মোজাফফরপুর এর এক স্থানীয় বাসিন্দারা বাড়িতে আশ্রয় লাভ করেন... বাড়ির মালিক প্রফুল্ল চাকীকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে যত্ন করেছিলেন এবং কলকাতা যাওয়ার টিকিট কেটে দিয়েছিলেন। কোলকাতা যাবার
মাঝপথে ট্রেন পরিবর্তন করতে হতো প্রফুল্ল চাকীকে ।তবে হাওড়া যাবার সেই দ্বিতীয় টেনে আর ওঠা হয়নি তার ।প্রথম ট্রেনের ভিতরেই তাকে দেখে সন্দেহ করে ব্রিটিশ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জি, খুব দ্রুতই তথ্য মিলিয়ে তিনি প্রফুল্ল চাকীর মোজাফফরপুর ঘটনার সাথে যোগ থাকার কথা উদঘাটন করেন। ট্রেন পরিবর্তন করতে প্রথম ট্রেন থেকে নেমে পড়তেই প্রফুল্ল চাকীকে নন্দলাল ব্যানার্জি ও তার কনস্টেবলরা ঘিরে ফেলেন। প্রফুল্ল চাকী প্রথমের নন্দলাল কে গুলি করে মারতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, তারপর তিনি নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তবুও ব্রিটিশ পুলিশের হাতে নিজেকে ধরা দেননি।
অন্য দিকে ক্ষুদিরাম মোজাফ্ফরপুর থেকে বের হবার পথ করছিলেন ঘটনার পরপর ই পুরো মোজাফফরপুর জুড়ে সশস্ত্র পুলিশে ছেয়ে যায়। বিশেষ করে ট্রেন স্টেশন গুলোতে বসানো হয় পুলিশের কড়া পাহারা। তাই ক্ষুদিরাম ঠিক করলেন হেঁটেই মোজাফফরপুর থেকে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার জন্য অপেক্ষা করছিল ওয়াইনি নামক স্থানে। দীর্ঘ পথ হেঁটে সেখানে একটু জলের জন্য একটি চায়ের দোকানে দাঁড়ালেন ক্ষুদিরাম, আর তখন পাশে থাকা কনস্টেবলদের সন্দেহের নজর ক্ষুদিরামের উপর পরে। তারা ক্ষুদিরামের দেহ তল্লাশি চালিয়ে একটি রিভলভার এবং ৩৭ রাউন্ড গুলি পান, গ্রেফতার হলেন ক্ষুদিরাম। দিনটি ছিল ১৯০৮ সালের ১লা মে । কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা একজন ১৪ বছরের যুবক। তাঁকে গ্রেফতার করে তখন মুজাফ্ফরপুর স্টেশনে নিয়ে আসা হলো তখন , হাজারো মানুষ ভীড় করেছে সেখানে একজন সন্ত্রাসী কে দেখবে বলে। চারিদিকে মানুষের বিস্ময় ভরা দৃষ্টির মধ্যে ক্ষুদিরাম কেবল কাঁপা কাঁপা গলায় অভিরাম বলে গেলেন, ‘বন্দেমাতারাম’। তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে নিয়ে গিয়ে পুলিশ মারধরসহ সব রকমের চেষ্টা চালিয়ে ছিল, সেই ঘটনার সাথে আর কে বা কারা যুক্ত আছে তা জানার জন্য। কিন্তু ক্ষুদিরামের মুখ থেকে একটি শব্দ বের হয়নি তার সাথীদের ব্যাপারে। তিনি পুরো ঘটনার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন।
কিন্তু যখন তার সামনে মৃত প্রফুল্ল চাকীর দেহ আনা হলো তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং সব স্বীকার করলেন।
আদালতের বিচার এবং মৃত্যু ক্ষুদিরামকে ২রা মে কারাগারে পাঠানো হয়, ২১ মে তার বিচারকার্য শুরু হয়। উপেন্দ্রনাথ সেন, কালিদাস বসু আর স্বেত্রানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার পক্ষের আইনজীবী হলে লড়াই করেন। তারা কেউই এই কাজের জন্য কোন প্রকার অর্থ নেন নি। তাদের উপদেশ অনুযায়ী ক্ষুদিরাম 23শে মে তারিখে নিজের প্রথম জবানবন্দিতে মোজাফফরপুর ঘটনার সাথে নিজের সংযোগ অস্বীকার করেন। আদালতে চূড়ান্ত রায়ের দিন ধার্য হয় ১৩ই জুন। এদিকে ১২ই জুন ঘটনায় অন্য মোড় আসে, আদালতের বিচারকরা একটি বেনামি চিঠি পান যাতে লেখা ছিলো-" আরো অনেক বড় বোমা হামলার ঘটনা ঘটবে যা কোন বাঙালি নয় বরং কোনও বিহারী রা ঘটাবে।" এই চিঠির প্রেক্ষিতে ক্ষুদিরামের আইনজীবীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ক্ষুদিরামের ফাঁসির রায় ঠেকাতে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার, বিদ্রোহী ও বিপ্লবী ক্ষুদিরাম কে ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে যা হবার তাই হলো আর ১৩ই জুন চূড়ান্ত রায়ে ক্ষুদিরামের ফাঁসির রায়ে হলো, তিনি হাসিমুখে সে রায় মেনে নিলেন এমনকি উচ্চ আদালতে আপিল করবেন না বলে দাও জানিয়ে দিলেন। কিন্তু তার উকিলরা তাকে এই বলে রাজি করালেন যে আপিল করে যদি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যায় তাহলে ক্ষুদিরাম পরবর্তীতে দেশের জন্য আরো অনেক কাজ করতে পারবেন। রাজি হলেন ক্ষুদিরাম, আপিল হলো উচ্চ আদালতে। এবার খুদি রামের পক্ষে লড়লেন নরেন্দ্র কুমার বসু।৮ই জুলাই প্রথম শুনানিতে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর ১৩ই জুলাই রায় এর দিন ধার্য করা হয়। নরেন্দ্র কুমার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে এই রায়ে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করার দিকে নিয়ে যান ঠিকই কিন্তু কোন উপায় হল না মৃত্যুদণ্ড শেষ পর্যন্ত বহাল থাকে। শেষে গভর্নরের কাছে আপিল করা হয় কিন্তু 11 ই আগস্ট ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল আপিল প্রত্যাখ্যান করে দিলে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। এই রায় সর্বস্তরের জনগণের মনের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। হাজারো মানুষ জড়ো হয় আদালতের সামনে তারা স্লোগান দিতে থাকে ক্ষুদিরামের পক্ষে। সংবাদপত্রগুলো ক্ষুদিরামের পক্ষে প্রচার প্রচার চালায়। কিন্তু মৃত্যু ছিল অবধারিত আর সেদিনই ক্ষুদিরাম হাসতে হাসতে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে পরেন ।
মৃত্যু সে আবার কী? ক্ষুদিরাম কে কী বোকা ব্রিটিশ সত্যিই মারতে পেরেছিল? বরং তরুণ প্রজন্মের মনে ক্ষুদিরামের মৃত্যুর জন্য প্রতিশোধের আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। ক্ষুদিরাম আসলেতো আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, তার বৈপ্লবিক আদর্শ আমাদের রক্তে বইছে ।লোক কবি পিতাম্বর দাসের সেই কালজয়ী গান যা আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে যায়।।
No comments