Bhaoal Raja ba Sonnyashi Raja
Bhawal Raja
![]() |
Add caption |
বড়ই বিচিত্র আমাদের এই পৃথিবী। কত ধরনের
অদ্ভুত সব ঘটনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের চারপাশে। মাঝে মাঝে বাস্তবেও আমাদের
এমন ঘটনার সাক্ষী হতে হয়, যার সাথে চলচ্চিত্রের কাল্পনিক গল্পের
পার্থক্য করাই মুশকিল হয়ে পড়ে।
রূপকথার অনেক কাহিনি শুনে আমরা মোহিত হই।
রহস্য ও রোমাঞ্চকর সেসব গল্পের ঠাই হয় সাহিত্য কিংবা চলচ্চিত্রে। কিন্তু বাস্তবে
সে সব রূপকথাকেও হার মানায় গাজীপুরের জয়দেপুরের ভাওয়ালের ‘মৃত ’রাজার সন্ন্যাসী হিসাবে আর্বিভাবের জমজমাট
কাহিনি।
![]() |
ভাওয়াল রাজবাড়ি |
এটি ছিল অবিভক্ত বাংলায় ইংরেজ শাসনকালে
অন্যতম চাঞ্চল্যকর ও আলোচিত ঘটনা।মৃত্যুর বারো বছর পর হাজির হয়ে জমিদারির অংশ ও
নিজের স্বীকৃতির দাবি তুললে পরিস্থিতি কী হতে পারে, ভাওয়ালের সন্ন্যাসী রাজার এই কাহিনি না শুনলে তা অনুমান করাও অসম্ভব।
ভাওয়াল রাজার এই গল্পটি বাস্তব হলেও গল্পে,
চলচ্চিত্রে, পত্র-পত্রিকায় ও নাটকে
বহুল আলোচিত এবং এখনও স্থানীয়দের মুখে রাণী বিভাবতী ও চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্তকে নিয়ে
রসাত্মক অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে। বিখ্যাত অভিনেতা উত্তম কুমারের চলচ্চিত্র ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ও আসন্ন সৃজিত মুখার্জির ছবি ‘এক যে ছিল রাজা’ নির্মিত হয়েছে এই ভাওয়াল রাজার গল্প
নিয়েই।
ঢাকার গাজীপুরের জায়দেবপুর সদরে রানি বিলাসমণি
সরকারি বালিকা বিদ্যালয় এর পাশে একটি রাজপ্রাসাদ রয়েছে, বর্তমানে এটি গাজীপুর জেলা
প্রশাসকের কার্যালয় হিসাবে।প্রতিদিন বহু পর্যটক এখানে আসেন এই রাজবাড়ির সৌন্দর্য
উপভোগ করতে। এই রাজবাড়ির মানুষজনদের নিয়েই এই গল্পের গোরাপত্তন।
![]() |
ভাওয়াল রাজা |
সন্ন্যাসীবেশে মৃত রাজার ফিরে আসার এক
অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে এই রাজবাড়ি। রাজা রাজেন্দ্রনারায়ন এর মৃত্যুর পর তিন
পুত্রকে জমিদারির বিভিন্ন অংশের দ্বায়িত্ত বুঝিয়ে দেওয়া হয়, এই তিন ভাই এর মধ্যে
দ্বিতীয়জন অর্থাৎ রমেন্দ্রনারায়নকেই ভাওয়াল রাজা বলা হয়।রাজা হিসাবে রমেন্দ্রনারায়ন
বেশ প্রজাবৎসল হলেও তিনি নারী সঙ্গে থাকাই বেশি পছন্দ করতেন।অতিরিক্ত মদ্যপান ও
নারীসঙ্গে থাকার জন্য রাজা সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হন। তখন রাজার চিকিৎসা করছিলেন
রাজার পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্ত। ১৯০৯ সালের ১৮ই এপ্রিল ডাক্তারের
পরামর্শ অনুযায়ী রাজাকে সস্ত্রীক দার্জিলিংএ পাঠানো হয় , সাথে চিকিৎসক, রাজার
শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ও রাজার আরও কিছু কাছের লোক ও যায়।
কথিত আছে ভাওয়াল রাজার স্ত্রী বিভাবতী
ছিলেন ব্যাভিচারিনি, পারিবারিক ডাক্তার আশুতোষ দাসগুপ্তের সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক
ছিল।বিভাবতী যখন গর্ভবতী ছিলেন তখন রাজা ছিলেন সিফিলিস রোগে আক্রান্ত। এ ঘটনায়
রাজা যখন রানি কে শাস্তি দিতে যান তখনই মেজ রানি ও ডাক্তার এর ফাঁদে পড়ে চিকিৎসার
জন্যে দার্জিলিংএ চলে যেতে হয় রাজাকে। দার্জিলিং এ চিকিৎসার জন্য নিয়ে গিয়ে
মেজরানি রাজাকে অসুস্থ করার জন্য স্বল্প মাত্রার বিষ প্রয়োগ করতে থাকেন, যাতে ধীরে
ধীরে রাজার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে ক্রমেই বেড়ে চলে তার অসুখ। অবশেষে ৭ই
মে ১৯০৯ রাজার মৃত্যু হয়, ডেথ সার্টিফিকেটে বলা হয় গলব্লাডারে পাথর রাজার মৃত্যুর
কারন। দার্জিলিং এই রাজার শেষকৃত্য হয় ও মে মাসের ১৮ তারিখ শ্রাদ্ধনুষ্ঠান হয়।
রমেন্দ্রনারায়নের জীবনাবসানের গল্পটি
এখনেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু না এখানেই শেষ হয়নি। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা মোড় নেয়
অন্যদিকে।
রাজার মৃত্যুর প্রায় ১২ বছর পর যখন
রাজ্যের দায়িত্ব রানি বিভাবতীর হাতে। ১৯২০/১৯২১ সাল এর দিকে ঢাকার বাকলান বাজারের
কাছে গেরুয়া পোষাক পরিহিত অত্যন্ত সুদর্শন এক জটাধারী সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে।
রাজ্যের অনেকেই সন্ন্যাসীকে দেখতে ও তার কথা শুনতে যান, সন্ন্যাসীর কথা বলার ধরন
এবং মুখের অবয়ব দেখে অনেকেরই সন্দেহ হতে থাকে। একদিন রাজা রমেন্দ্রনারায়নের এক
বিশ্বস্ত দেহরক্ষী সন্ন্যাসীকে চিনে ফেলেন। সে তখন রাজা এসেছে বলে চারিদিকে রটিয়ে
দেয়, অল্পসময়ের মধ্যেই রাজ্যের চারিদিকে শোরগোল পড়ে যায়।তখন সন্ন্যাসী নিজমুখে
স্বীকার করেন যে তিনিই রাজা রমেন্দ্রনারায়ন।
খবর রাজার বোন জ্যোতির্ময়ীদেবী কাছে পৌছলে
তিনি সন্ন্যাসীকে নিজের প্রাসাদে আনতে লোক পাঠান। জ্যোতির্ময়ীদেবী সন্ন্যাসীকে
পরীক্ষা করলেন এবং ছোটোবেলার অনেক কথা জিজ্ঞাসা করলেন। সন্ন্যাসীর উত্তরে জ্যোতির্ময়ীদেবী
খুব অবাক হয়ে যান। কেননা, তিনি এমন সব
প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন যা ছিল দুই ভাইবোন এর ছোটবেলার স্মৃতি সম্পর্কিত। জ্যোতির্ময়ীদেবী
লক্ষ করেন সন্ন্যাসীরও খাওয়ার সময় তার ভাইএর মত তর্জনী আলগা হয়ে আসে ও জিভ সামনে
খানিক বেরিয়ে আসে। জ্যোতির্ময়ীদেবীর সাথে উপস্থিত লোকজন সন্ন্যাসীর পরিচয় নিশ্চিত হতে
অনেক সওয়াল জবাব করেন ও রীতিমতো পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেন।জমিদার পরিবারের
খুঁটিনাটি বিষয়, তার বাবার নাম তার মায়ের নাম, এমন কি যে দাইমার কাছে তিনি মানুষ
তার নাম ও জানতে চাওয়া হয়। পরীক্ষায় সহজেই উত্তীর্ণ হন সন্ন্যাসী। তাকে রাজাহিসাবে
মেনে নেবার পিছনে আরও একটি কারন ছিল, তার মারা যাবার সময় শ্মশানে যখন নিয়ে যাওয়া
হয় তখন প্রচন্ড বৃষ্টি নামার ফলে দাহকারীরা শ্মশানে রাজাকে ফেলে রেখেই চলে যায়। বৃষ্টি কমে এলে তারা
গিয়ে সেখানে কোনো মরা খুঁজে পায় নি । রাজার
সাথে দার্জিলিং যাওয়া লোকদের মুখেই এ ঘটনা সকলের শোনা ছিল।
তবুও তারা সেদিন এর ঘটনা রাজার কাছে জানতে
চান, কি ঘটেছিল সেদিন। রাজার কথা অনুযায়ী- সেই রাতে কিছু সাধু শ্মশানের ভিতর দিয়ে
যাচ্ছিলেন, পথে একটি লোক কে পড়ে থাকতে দেখে তাকে পরীক্ষা করে তারা দেখেন যে সে
জীবিত। তখন সাধু গুলো লোকটিকে(রাজাকে)নিজেদের ডেরায় নিয়ে যান। সাধুদের শুশ্রূষায়
রাজা সুস্থ হয়ে ওঠেন। রাজার স্মৃতি লোপ পেয়েছিল তাই তিনি সাধুদের সাথেই ঘুরে
বেড়াতেন। অনেক বছর কাটার পর তার মনে পরতে থাকে পুরানো কথা, তিনি ফিরে আসেন।
রাজাকে যখন পাওয়া গেল তখন রাজকার্য বুঝিয়ে
দেওয়া উচিত, কিন্তু বাধ সাধেন রানি বিভাবতী দেবী, তিনি সন্ন্যাসীকে রাজা বলে মানতে
রাজী ছিলেন না। রাজার পক্ষের লোকেরা উপায়
না দেখে আদালতের স্বরনাপন্ন হলেন।
আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকার্য শুরু হয় ১৯৩৩
সালের ৩০এ নভেম্বর। প্রথমেই বিবাদীপক্ষের উকিল সন্ন্যাসীর পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন,
উকিল এর যুক্তি হিসাবে ভাওয়াল রাজ্যের সম্পত্তির লোভেই সন্ন্যাসী রাজা সেজে ঠকবাজি
করছে।কিন্তু বাদীপক্ষের উকিলের এক এর পর এক সাক্ষী ও প্রমানের জোরে বিবাদী পক্ষের
সকল যুক্তি খণ্ডন হতে থাকে, মামলা সবচাইতে গুরুত্তপূর্ণ মোড় নেয় তখন যখন সন্ন্যাসী
রাজ্যের সকল ঘটনা, রাজবাড়ির সকল সদস্যদের গল্প, বিভিন্ন মূল্যবান আসবাব ও ধনরত্নের
কথা একের পর এক বলে যেতে থাকেন। বাদী বিবাদী মিলে প্রায় ‘কয়েক শ’ সাক্ষী উপস্থিত
হয় আদালতে।এই মামলা নিয়ে সকলের কৌতূহল ছিল চরম। সন্ন্যাসী রাজা দাবি করেন তাকে
দার্জিলিং এ নিয়ে গিয়ে কৌশলে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হয়, তিনি রানী বিভাবতী, তার ভাই
সতেন্দ্রনাথ এবং ডাক্তার কে দায়ি করেন।
মামলার শুনানি প্রায় দু মাস ধরে চলে, ১৯৩৬
সালের ২৪শে অগাস্ট বিছারক পান্নালাল বসু বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ সন্ন্যাসীর পক্ষে
রায় দেন। তবাএ এই রায় এরপরেও বিভাবতী দেবী থেমে থাকেননি।১৯৪৩ সালে বিভাবতীর আইনজীবীরা
লন্ডনের privy council এ আপিল করেন। ১৯৪৫ সালে আবার শুনানি শুরু হয়।২৮ দিনের শুনানি শেষে ১৯৪৫ সালের
৩০শে জুলাই ব্রিটিশ বিচারকরা সন্ন্যাসীর পক্ষে রায় দেন এবং আপিল নাকচ করে দেন। ফলে
আইনত জমিদারির পূর্ণ অংশের অধিকার পান সন্ন্যাসী রাজা। কিন্তু ততদিনে রাজার বিষয়
আশয় এর উপর লালসা চলে যায় ,সন্ন্যাস জীবনে ফিরে যান রাজা।
👍👍
ReplyDelete👍👍👍
ReplyDelete