স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু

স্মরণে স্যার স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু

লিখেছেন - ঊর্মি তনচংগ্যা
ঋণ- নিয়ন আলোয়

****
বিজ্ঞানের বইয়ে বড় বড় করে লেখা ছিল-“বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু গাছেরও যে প্রাণ আছে তা আবিষ্কার করেন”। গাছের যে কি প্রাণ, আর তারই বা কিসের আবিষ্কার তা সেই বয়সে মাথায় ঢুকেনি। পরে স্যার ক্লাশে এই বাঙালি বিজ্ঞানীর সম্পর্কে আর তার আবিষ্কার সম্পর্কে যখন বললেন, তখন অল্পবয়সে এতোকিছু না বুঝলেও উনার অসামান্য মেধার কথা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। পরে লজ্জাবতী গাছে স্পর্শ করলেই মনে হত যে উনি ঠিকই বলেছেন, “গাছেরও প্রাণ আছে”।
কিন্তু তখনো জানতাম না যে এই বিজ্ঞানী শুধু উদ্ভিদবিজ্ঞান নয়, একই সাথে পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞানেও সমান মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন।
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুঃ অব্যক্ত প্রাণের আবিষ্কারক এক বাঙ্গালী- নিয়ন আলোয়
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু
গুনী এই বিজ্ঞানীর জন্ম হয় ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি অঞ্চলের মুন্সীগঞ্জ এলাকায়। বাবা ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ভগবান চন্দ্র বসু, তখনকার ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।
ছোটবেলা থেকেই দেশপ্রেমের শিক্ষা
মায়ের হাতেই শিশু জগদীশের হাতেখড়ি হয়েছিল। ধীরে ধীরে স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় আসলো। তখনকার দিনে সন্তানকে ইংরেজি স্কুলে পড়ানো ছিল উচ্চ সামাজিক মান-মর্যাদার বিষয়। তাই ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে জগদীশ চন্দ্র বসু যে ইংরেজি স্কুলে যাবেন, এটা তো জানা কথা। কিন্তু ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ, তিনি চাইতেন ইংরেজি শেখার আগে উনার সন্তান ভালো করে মাতৃভাষা শিখুক আর সন্তানের মধ্যে অল্পবয়সেই দেশপ্রেম গড়ে উঠুক। বাংলা স্কুলে পড়ার ব্যাপারটি জগদীশ চন্দ্রের জীবনে যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে তার প্রমাণ বাংলা ভাষায় রচিত জগদীশের বিজ্ঞান প্রবন্ধগুলো পড়লে সহজেই বোঝা যায়। তাঁর পিতার এই চেষ্টা যে বিফলে যায়নি তার প্রমাণ জগদীশ চন্দ্র বসুর পরবর্তী জীবনের নানান ঘটনাবলী।
গ্রামের বিদ্যালয়ে সব স্তরের ছেলের সাথে মিলে-মিশে ছোট্ট জগদীশ বড় হতে লাগলেন। ভাবুক এই ছেলে প্রতিদিন বিকালে নদীর পাড়ে গিয়ে হাজির হতো আর আপনমনে গাছদের দেখত, আর চিন্তা করত বসে বসে।
উচ্চতর শিক্ষার জন্য গ্রামত্যাগ
গ্রামের পড়ার পাট চুকিয়ে জগদীশ কলকাতায় গেলেন আরো পড়ার জন্য। সেখানে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে বিএ পাশ করেন কৃতিত্বের সাথে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াকালীন ইউজিন ল্যাফন্ট নামক একজন খ্রিষ্টান যাজক তাকে খুব স্নেহ করতেন, তার কারণেই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর জগদীশের আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
বিএ পাশ করেছেন, এখন চাকরি করতে হবে। তাই আইসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি পিতার কাছে ইংল্যান্ডে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু পিতা ভগবান চন্দ্রের ইচ্ছা ছিলনা যে ছেলে আইসিএস-এ জয়েন করুক, তিনি চেয়েছিলেন ছেলে দেশের দরিদ্র মানুষের উপকারে আসবে এমন কিছু নিয়ে পড়ুক।
তাই ডাক্তারী পড়ার জন্য তিনি ১৮৮০ সালে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তার মনে হয়তোবা অন্য কিছু ছিল।বিলেতের আবহাওয়া আর ডাক্তারী পড়ার অত্যধিক চাপে দুর্বল স্বাস্থ্যের জগদীশ চন্দ্র বসু অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার কারণে বেচারার ডাক্তারী পড়া ছেড়ে দিতে হয়। এখন তিনি কি করবেন?
পড়ে এই অবস্থা দেখে তাঁর ভগ্নীপতি আনন্দমোহন বসু জগদীশ চন্দ্রকে প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্বন্ধে শিক্ষালাভের কথা বলেন। তার উদ্যোগে জগদীশ জন উইলিয়াম স্ট্রাট, ৩য় ব্যারন রেলি, মাইকেল ফস্টার, জেমস ডেওয়ার, ফ্রান্সিস ডারউইন এর মত বিখ্যাত বিজ্ঞান শিক্ষকদের জ্ঞানকেন্দ্র কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হয়ে সাফল্যের সাথে ট্রাইপস পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন।
দেশের তরে,দেশের মাটিতে
অনেক তো জ্ঞান অর্জন হলো, এবার দেশের মাটিতে ফেরা যাক। এই ভেবে ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে জগদীশ চন্দ্র ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। তখন প্রেসিডেন্সী কলেজ ছিল শীর্ষ শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম, কিন্তু এখানে বাঙালী বিজ্ঞানের ছাত্র কিংবা শিক্ষক ছিল হাতেগোনা। তাই তৎকালীন ভারতের গভর্নর-জেনারেলের অনুরোধে স্যার অ্যালফ্রেড ক্রফট বসুকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত করেন। তবে এখানেও ঝামেলার শেষ ছিলোনা। প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যক্ষ চার্লস হেনরি টনি ছিলেন অত্যন্ত বাঙালি বিদ্বেষী, তিনি প্রথম থেকেই বাঙালী শিক্ষক নিয়োগের বিপক্ষে ছিলেন। এত আপত্তির পরও জগদীশের নিয়োগ পাওয়ায় তিনি প্রতিহিংসাবশত পদে পদে ঝামেলা করতে লাগলেন। টনি সাহেব জগদীশের বেতন অন্য ইউরোপীয় শিক্ষকের অর্ধেক করে দিলেন, গবেষনার কোনো রকম সুযোগ তাকে দেওয়া হতোনা। আর্থিক অভাব থাকা সত্ত্বেও জগদীশ চন্দ্র বসু এই অপমানের প্রতিবাদে তিন বছর অবৈতনিক ভাবেই অধ্যাপনা চালিয়ে যান। তার এই অহিংস প্রতিবাদের ফলে পরবর্তীতে তাঁর বেতন ইউরোপীয়দের সমতুল্য করা হয়।
এত কিছুর পরেও তিনি নিজের মনোবল হারাননি। ২৪ বর্গফুটের নিজের কক্ষে তিনি একের পর এক গবেষণা করতে থাকেন। সারাদিন ক্লাস নেওয়ার পরেও তিনি নিজের চেষ্টায় অনেক কষ্ট করে অপ্রতুল যন্ত্রপাতি দিয়ে নিজের কাজ করতেন, আর এই সময় যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে তাঁকে সঙ্গ দেন স্ত্রী অবলা বসু।
তার গবেষণাপত্রগুলো লন্ডনের রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হলে চারিদিকে সাড়া পরে যায়। নুন্যতম জিনিস ব্যাবহার করে ভারতবর্ষের মত এক দেশে বসে তিনি এত গবেষণা করেছেন দেখে পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের তাক লেগে যায়। তার কাজের স্বীকৃতি সরূপ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাকে ডিএসসি ডিগ্রী প্রদান করে।
নিজের কাজ সম্পর্কে বলার জন্য ইংল্যান্ডের লিভারপুলে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এই বক্তৃতার সাফল্যের পর তিনি রয়েল ইন্সটিটিউশন, ফ্রান্স এবং জার্মানিসহ বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বক্তৃতা দেন।
মাইক্রোওয়েভ এবং জগদীশের গবেষণা
জগদীশ চন্দ্র বসুর গবেষণার মুল বিষয় অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ, ১৮৯৫ সালে তিনি এই অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন এবং কোন তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সফলতা পান। জগদীশচন্দ্র বিজ্ঞানী হার্ৎজ এর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরি করেন। আজকের আধুনিক বিশ্বের রাডার, টেলিভিশন এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ব্যাবহার অনস্বীকার্য। পরবর্তীতে জগদীশ চন্দ্র বসুর এই থিম ব্যাবহার করে মারকনি রেডিও আবিষ্কার করেন।
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুঃ অব্যক্ত প্রাণের আবিষ্কারক এক বাঙ্গালী- নিয়ন আলোয়
এসবের পাশাপাশি তিনি উদ্ভিদের বৃদ্ধিমাপক যন্ত্র ক্রেস্কোগ্রাফ, উদ্ভিদের দেহের উত্তেজনার বেগ নিরূপক সমতল তরুলিপি যন্ত্র রিজোনাস্ট রেকর্ডার অন্যতম। উত্তেজনার বেগ নিরূপণের মাধ্যমেই তিনি উদ্ভিদে প্রাণের অস্তিত্বের প্রমাণ দেন সর্বসমক্ষে।
বিজ্ঞানের ভাষায় সাহিত্যকর্ম
বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু সহজ ভাষায় নিজের গবেষণার কথা ছাপা পক্ষরে লিখে গিয়েছেন। তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ রেসপন্সেস ইন দ্য লিভিং অ্যান্ড নন-লিভিং (১৯০২), প্লান্ট রেসপন্সেস এজ এ মিনস অব ফিজিওলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশনস (১৯০৬), কম্পারেটিভ ইলেকট্রফিজিওলজি (১৯০৭), নার্ভাস মেকানিজম অব প্লান্টস (১৯২৫), কালেক্টেট ফিজিক্যাল পেপার্স (১৯২৭), মটর মেকানিজম অব প্লান্টস (১৯২৮) ও গ্রোথ এন্ড ট্রপিক মুভমেন্ট ইন প্লান্টস (১৯২৯)।
ছোটদের জন্যও তার বাংলায় লেখা বই রয়েছে, ‘অব্যক্ত’ নামের বইয়ে খুব সরলভাবে বিজ্ঞানের অনেক কঠিন কথা বলা হয়েছে।
কাজের সম্মাননা
তিনি ১৯১৬ সালে ব্রিটিশ সরকার থেকে নাইটহুড উপাধি পান, পরে রয়েল সোসাইটির ফেলো হন ১৯২০ সালে, ১৯২৮ সালে ভিয়েনা একাডেমি অফ সাইন্স-এর সদস্য নির্বাচিত হন।
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুঃ অব্যক্ত প্রাণের আবিষ্কারক এক বাঙ্গালী- নিয়ন আলোয়
এছাড়া, দেশের ১৯২৭ ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ১৪তম অধিবেশনের সভাতিত্ব করেন এই বরেণ্য বিজ্ঞানী। তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সাইন্সেস অফ ইন্ডিয়া-এর ফাউন্ডার ফেলো ছিলেন।
বাঙালিরাও বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে কোনো অংশে যে কম যায়না, বরং সুযোগ পেলে তারা পশ্চিমাদের চেয়েও উচ্চ হতে পারে তা জগদীশ চন্দ্র বসু চোখে আঙ্গুল দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। লন্ডনের বিখ্যাত ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা তাকে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী বলে স্বীকৃতি দেন।
আর আইনস্টাইন ভাষ্যমতে-“জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত”।
১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর এই প্রথিতযশা বিজ্ঞানী মারা যান।

No comments

Theme images by luoman. Powered by Blogger.