ভারতীও বিজ্ঞাপনের ব্র্যান্ড ফাদার
আটের দশকের সাদা-কালো বাক্স যুগেও রঙিন বিপ্লব ঘটেছিল সেই বিজ্ঞাপন। যেখানে সবুজ স্বল্প বাসনা থেকে বেরিয়ে থাকা অঙ্গে লাগতো লেবু-সতেজ লিরিল এর ছোঁয়া। লা...লালালা... বিজ্ঞাপনের সুর. দূরদর্শনে শনি-রবির সিনেমা, হাতেগোনা সিরিয়ালের আগে পরে সেই বিজ্ঞাপন স্বপ্ন দেখাতো মধ্যবিত্ত পুরুষ এমনকি ঘরের মহিলাদেরও। এরপর রঙিন টিভির রমরমা বাজারেও দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই বিজ্ঞাপন। দোকানে দোকানে তখন, লিরিল বিক্রি তুঙ্গে। ভারতীয় দর্শকের কাছে বিকিনি পরিহিতা নারী তখনো এত সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি।লিলগার্ল মানে তাই তখন এক কল্পলোকের শিহরণ। স্রষ্টা অ্যালেক পদমসি।তিনি বিশ্বাস করতেন সারা জীবন তিনি সেই সতেরো বছরে আটকে থাকবেন।
![]() |
padamsee ads |
বিজ্ঞাপনের রসায়ন ঘিরে থাকে একটি কথায়, পণ্যের সঙ্গে এমন একটা আবেগের যোগসুত্র গড়ে তুলতে হবে যে, ক্রেতা সেই আবেগের টানেই জিনিস টি কিনবেন। বেশ কয়েক দশক আগে ঠিক এই কাজটাই করেছিলেন অ্যালেক। বিকিনিসুন্দরীর সঙ্গে চনমনে লেবু এবং ঝর্না মিলিয়ে এমন একটি অনুভব তৈরি করলেন যে, সাবান টির কথা মনে হতেই জনমনে সেই আবেগটাই ভেসে এলো। এই বিজ্ঞাপন যেন গৃহবধূদের কাছে এক ঝলক মুক্তির বাতাস। প্রথম লিরিল কন্যা হয়েছিলেন এয়ারইন্ডিয়ার বিমান সেবিকা কারেন লানেল। ১৯৮৫ সালের পর এই বিজ্ঞাপনে সামিল হয়েছেন অনেক মডেল। পুজা বাত্রা, প্রীতি জিন্টা ,দীপিকা পাড়ুকোন তবে সেই সব বিজ্ঞাপন থেকে গিয়েছে প্রথমটির ছায়া হয়েই। পদমসীকে বাদ দিয়ে লিরিল এর বিজ্ঞাপন ভাবা যায় নাকি!
তিনি যে ভারতের ‘ব্র্যান্ড ফাদার’
বিজ্ঞাপনের কিছু চরিত্র ভারতীয়রা চট করে ভুলবেন না। মনে পড়ে? সেই দূরদর্শনের একাধিপত্যের দিনগুলোয় প্রতিটি ভারতীয় ছিলেন বিজ্ঞাপন-বিলাসী। বুলন্দ ভারত কি বুলন্দ তসবির “হামারা বাজাজ” অথবা “সস্তে আউর আচ্ছে চিজ মেফরক হোতা হে” ।সে তো সকলের ঠোটস্থ ছিল। সে এক অসামান্য সময়। ভারতের ঘরে ঘরে ঢুকেছে বিশ্বায়নের হাতছানি। খেতে খেতে ঘুমাতে ঘুমাতে পণ্য জগতের একজন হয়ে উঠছেন প্রতিটি ভারতীয়। নিজেরই অজান্তে চলমান বিজ্ঞাপনের সেই মরুবিজয়ের কেতন ওড়ানোর দিন গুলিতে কে না সেই কর্মকাণ্ডের শরিক হয়েছেন। কিন্তু ক’জন জানেন লিরিলগার্ল, চেরি ব্লসম শু পালিশ এর চার্লি চ্যাপলিনের অ্যাড, সার্ফ সাবানের লতাজির ক্যাম্পেইন, হামারা বাজাজ বিজ্ঞাপনের স্রষ্টা কে? স্রষ্টা তো এক জনি অ্যালেক পদমসি। সারা দুনিয়া তাকে চেনে- ‘অ্যাড গুরু’ হিসাবেই। ভারতীয় বিজ্ঞাপন জগতে যিনি প্রচুর সংস্থার ব্র্যান্ডভ্যালু মজবুত করেছেন। সাদাকালো টেলিভিশনের প্রথম যুগে দেখা অ্যাড এর জনক তিনিই।
দেশের গ্রামীণ সমবায় শিল্পোদ্যোগকে যিনি ‘আমূল’ বদলে দিয়েছিলেন, যার হাত ধরেই এসেছিল শ্বেতবিপ্লব সেই ভার্গিস কুরিয়েন বুঝেছিলেন দুধ উৎপাদনের পাশাপাশি একটা ব্র্যান্ড নেম দরকার। ফলে ১৯৫৫ সালে আত্মপ্রকাশ করেছিল ব্র্যান্ড আমূল। ‘আমূল’ হল-আনন্দ মিল্ক ইউনিয়ন লিমিটেড এই 4 টি শব্দের প্রথম অক্ষর নিয়ে তৈরি। উৎপাদনের গুণমানের পাশাপাশি কুরিয়েন ব্যবহার করেছিলেন অনবদ্য প্রচার কৌশল। কোনও সেলিব্রেটির মুখ ধার না করে, সাদার উপরে লাল ছিট ছিট জামা পরা এক বাচ্চা মেয়েকে তুলে ধরলেন প্রচারে। যা পাঁচ দশক পেরিয়ে আজও অবিচল। এক অন্য জনপ্রিয়তা। শোনা যায় তিনি বিজ্ঞাপন সংস্থা কেও পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। লেখা হয়েছিল ‘আটার্লি বাটার্লি ডিলিশিয়াস আমূল’ এর মত শ্লোগান। বিজ্ঞাপনের ইতিহাসে এটি একটি দিকচিহ্ন। ১৯৬৬ সালে সিলভেস্টার ডাঃ কুনহা-এর হয়ে মোক্ষম তাসটি খেলেছিলেন অ্যালেক। রাজনীতি, খেলা এবং সিনেমা এই সবই হল আমুলের প্রধান টপিক। চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে একটি বাচ্চা মেয়ে কি বলছে, সেটাই হলো বিজ্ঞাপনের মূল স্ট্রাটেজি। কলকাতার বেশ কয়েকবার এসেছে এই আমূল বিজ্ঞাপনে। সত্তরের দশকের গোড়ায়, যখন মিছিলে মিছিলে ছয়লাপ শহর, তখন আমূল গার্ল বলেছিল- ‘ব্রেড উইদআউট বাটার চলবে না’, চলবে না।জগমোহন ডালমিয়ার ঘটনা নিয়ে বলেছিল- ‘ডাল মিয়া মে কালা হে’ আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী তখন মেয়েটির মুখে শোনা গিয়েছিল ‘দিদি জ্বালাইলে’। প্রত্যেক টাই ফ্রাইডে টু ফ্রাইডে স্টার’- এর অভিধা পেয়েছিল। এই বিজ্ঞাপনের শুরুতে জড়িয়েছিলেন পদমশি। তিনি সিলভেস্টারডা কুনহা-র শিল্প নির্দেশক ইউষ্ট্যাস ফার্নান্ডেজের সঙ্গে হাত মেলালেন।১৯৬৬ সালের অক্টোবরে বোম্বে শহরের বাস স্ট্যান্ড আর ল্যাম্প কিয়স্ক গুলো একটা ঘোড়ায় চড়া পুতুল মেয়ের ছবিতে ছেয়ে গেল। নিচে শুধু লেখা ছিল- ‘আটারলি বাটারলি ডিলিশিয়াস আমুল’। সেই ছিল শুরু। তারপর থেকে আমুলের যত বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে সবই সমসাময়িক বিষয়ভিত্তিক। পদমশি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ‘তাজমহলের গায়ে যেমন কোনোদিন পুরনো জামানার তকমা লাগে নি, আমুল গার্লও তেমনি কোনদিন পুরানো হবে না’।
পদ্মশ্রী প্রাপ্ত অ্যালেক পদমশির ইংরেজি শেখা কিন্তু স্কুলেই। ১৯২৮ সালে গুজরাটের কচ্ছে, খোজা মুসলিম পরিবারে জন্ম। বাবা ধনী ছিলেন। কিন্তু শিক্ষিত ছিলেন না। আট সন্তানের মধ্যে শুধু ছেলেদেরই স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। মুম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা। তারপরই বিজ্ঞাপনের জগতে প্রবেশ। দাদা পেন্টার আকবর পদমশি।
থিয়েটার এর জগতেও সফল ‘অ্যাড গুরু’ ভারতীয় ইংরেজি থিয়েটারেও এক ভীষণ পরিচিত নাম ছিলেন তিনি। ইংরেজি ভাষায় লেখা দেশীয় নাট্যকারদের নাটক থিয়েটার এর মঞ্চে সফলভাবে মঞ্চস্থ হয়েছিল তার উদ্যোগে।
‘এভিটা’ ‘জেসাস ক্রাইস্ট সুপারস্টার’, এর মতো আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসিত নাটকের স্রষ্টা অ্যালেক। পেয়েছিলেন সংগীত নাটক একাডেমীর লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড। শেষ নির্দেশিত নাটক ‘ব্রোকেন ইমেজেস’ কয়েক বছর আগেই আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছিল। কিন্তু থিয়েটার এর থেকে বেশি বিখ্যাত ছিলেন তাঁর বিজ্ঞাপনী ক্যারিয়ারের জন্য। তিনি ছিলেন লিন্টাস অ্যাডভার্টাইজিং- এর প্রধান কার্যনির্বাহী আধিকারিক। তাঁর নেতৃত্বেই ভারতের অন্যতম নামই এড এজেন্সি হয়ে ওঠে লিনটাস। বিজ্ঞাপন লেখা নিয়ে তার বই ‘আ ডবল লাইফ’ আজ পড়ানো হয় দেশ-বিদেশের ম্যানেজমেন্ট স্কুলেও। অভিনেতা হিসেবে ভারতের দর্শক তাকে চিরকাল মনে রাখবেন রিচার্ড অ্যাটেনবরোর ‘গান্ধী’ ছবি জন্য। গান্ধী ছবিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয়ের জন্য পদামসি কে মনে রাখবে মানুষ।
শিল্প ও সংস্কৃতি জগতে অবদানের জন্য ২০০০ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১২ তে পেয়েছিলেন সংগীত নাটক একাডেমির ‘টেগোর রত্ন’ পুরস্কার। গত ১৭ নভেম্বর মুম্বাইয়ের হাসপাতালে 90 বছর বয়সে মারা যান ভারতীয় বিজ্ঞাপনের জগতের অন্যতম প্রাণপুরুষ।
No comments